সোমবার, ৫ই মে ২০২৫, ২২শে বৈশাখ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


কৃষি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যের হুমকি যখন ইটভাটা


প্রকাশিত:
৫ মে ২০২৫ ০৯:৫৮

আপডেট:
৫ মে ২০২৫ ১৩:২৯

ছবি সংগৃহীত

ইটভাটার ক্ষতি কতটা ভয়াবহ তা আমাদের জানা। ২০২৪ সালের তথ্য বলছে, দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা চালু আছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হচ্ছে। এসব ইটভাটার বছরে ১৩ কোটি মেট্রিক টন মাটি লাগে।

ইটভাটার দূষণ কৃষি পরাগায়নে বড় বাধা:

ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ক্ষতিকর গ্যাস (যেমন সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড) বাতাসে মিশে পরিবেশ দূষিত করে। পরাগকণা (pollen) বায়ুর মাধ্যমে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে পৌঁছে। কিন্তু দূষিত বাতাসে এই পরাগকণাগুলো ধ্বংস হতে পারে বা তাদের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে।

কীটপতঙ্গের (পরাগায়নকারী) ক্ষতি: মৌমাছি, প্রজাপতি ও অন্যান্য পরাগায়নকারী পোকামাকড় ইটভাটার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধোঁয়া ও ধূলিকণায় তারা দিশেহারা হয়ে যায়, ফলে পরাগায়নের হার কমে যায়। বিষাক্ত গ্যাসের কারণে অনেক পরাগায়নকারী পোকা মারা যায় বা তাদের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যায়।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও পরাগায়নের বিঘ্ন: ইটভাটা থেকে অতিরিক্ত তাপ নির্গত হয়, যা স্থানীয় জলবায়ুকে উত্তপ্ত করে তোলে। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ফুলের পরাগ তৈরি বা সংরক্ষণে সমস্যা হয়। অনেক কীটপতঙ্গ বেশি গরম সহ্য করতে না পেরে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়, ফলে প্রাকৃতিক পরাগায়ন ব্যাহত হয়।

ফুল ও ফসলের ক্ষতি: ইটভাটার ধোঁয়া ও ধূলিকণা আশপাশের গাছপালার ওপর জমে, যা ফুলের গঠন ও পরাগ উৎপাদনে বাধা দেয়। ফুলের ওপর ধুলা জমে থাকলে পরাগ ঝরে পড়ে বা পরাগায়নকারীরা আকৃষ্ট হয় না। ফল ও ফসলের উৎপাদন কমে যায়, বিশেষত মৌসুমি শাকসবজি ও ফলের ক্ষেত্রে।

সম্ভাব্য সমাধান: ইটভাটা আবাসিক ও কৃষিজমি থেকে দূরে স্থাপন করা। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়ুদূষণ কমানো। বিকল্প নির্মাণসামগ্রী (যেমন ব্লক ইট) ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান। পরাগায়নকারী কীটপতঙ্গ সংরক্ষণের জন্য গাছপালা ও সবুজায়ন বাড়ানো। পরাগায়ন কৃষিজ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইটভাটার দূষণ কমিয়ে ও পরিবেশবান্ধব উপায় অবলম্বন করে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি।

কৃষি জমিতে ইটভাটা একটি অভিশাপ:

কৃষি জমি আমাদের খাদ্য উৎপাদনের মূল ভিত্তি, কিন্তু ইটভাটার প্রসারের ফলে উর্বর কৃষি জমি দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে। এটি শুধু কৃষির জন্য নয়, সামগ্রিক পরিবেশ ও মানুষের জীবিকার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়া: ইট তৈরির জন্য উপরের উর্বর মাটির স্তর কেটে নেওয়া হয়, যা জমির উর্বরতা কমিয়ে দেয়, ফলে ফসল ফলানোর সক্ষমতা কমে যায়। জৈব উপাদান (Humus) ধ্বংস হয়, যা গাছের পুষ্টি গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।

কৃষি উৎপাদনে মারাত্মক ক্ষতি: ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক পদার্থ আশপাশের ফসলের ওপর পড়লে—গাছপালার পাতায় ধুলা জমে- সংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। বিষাক্ত গ্যাস (SO₂, NO₂) ফসলের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয় এবং ফসল নষ্ট করে। পরাগায়ন ব্যাহত হয়, ফলে ফল ও শস্য উৎপাদন কমে যায়।

জলবায়ুর পরিবর্তন ও খরা বৃদ্ধি: ইটভাটার কারণে স্থানীয় তাপমাত্রা বাড়ে, যা মাটির আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত তাপের কারণে শুষ্ক অবস্থা সৃষ্টি হয়, যা বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন করতে পারে। এতে খরা ও অনাবৃষ্টির প্রবণতা বেড়ে যায়, যা কৃষিকে আরও সংকটময় করে তোলে।

জল দূষণ ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাওয়া: ইটভাটার রাসায়নিক বর্জ্য বৃষ্টির মাধ্যমে কৃষি জমির মাটিতে মিশে গিয়ে জল দূষণ ঘটায়। অনেক ইটভাটা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে, ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, যা সেচের জন্য মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে।

কৃষকের জীবিকা হুমকির মুখে: ইটভাটার কারণে জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে গেলে কৃষকরা জমি হারিয়ে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে বাধ্য হয়ে কৃষি ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হন, যা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ সংকেত।

সম্ভাব্য সমাধান: কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মাণের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। ইট তৈরির জন্য বিকল্প উপকরণ (যেমন কংক্রিট ব্লক) ব্যবহার করা। পরিবেশবান্ধব ইটভাটা প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ কমানো। জমির উর্বরতা রক্ষা করতে বনায়ন ও মাটির সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কৃষি জমিতে ইটভাটা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি ভয়াবহ অভিশাপ। খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষির সুরক্ষার জন্য অবৈধ ও অনিয়ন্ত্রিত ইটভাটা নির্মাণ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

ইটভাটায় বিপন্ন পরিবেশ

ইটভাটা আমাদের গৃহনির্মাণ শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তবে এর প্রভাব পরিবেশের ওপর গভীর এবং ধ্বংসাত্মক। ইট প্রস্তুতিতে প্রচুর পরিমাণে মাটি, কয়লা ও কাঠ ব্যবহৃত হয়, যা সরাসরি ভূমি, বায়ু এবং জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ভূমির ক্ষতি: ইট তৈরির জন্য কৃষিজমি থেকে উপরের উর্বর মাটি সংগ্রহ করা হয়। এর ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়, কৃষিজ উৎপাদন কমে যায় এবং জমি ধীরে ধীরে অনুর্বর হয়ে পড়ে।

বায়ুদূষণ: ইটভাটায় কয়লা, কাঠ বা অন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂), সালফার ডাই-অক্সাইড (SO₂), কার্বন মনোক্সাইড (CO) এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এই দূষিত বায়ু শ্বাসতন্ত্রের রোগ, অ্যাজমা এবং ফুসফুসজনিত নানা সমস্যার কারণ হতে পারে।

জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: ইটভাটা স্থাপনের জন্য বন উজাড় করা হয়, যার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়। অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যায় এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে।

জলবায়ুর পরিবর্তন: ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস গ্রিনহাউস এফেক্ট সৃষ্টি করে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হয়, যা আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।

নিকটবর্তী জনবসতির ক্ষতি: ইটভাটার ধোঁয়া ও ধূলিকণা আশপাশের গ্রাম ও শহরের বায়ুকে দূষিত করে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ ও চোখের সংক্রমণের মতো নানা সমস্যায় ভোগেন।

সমাধান ও সুপারিশ: পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির প্রযুক্তি ব্যবহার করা। অবৈধ ও অনিয়ন্ত্রিত ইটভাটা বন্ধ করা। বিকল্প নির্মাণসামগ্রী (যেমন ব্লক ইট) ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান। গাছ লাগানো ও বন সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া।

পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের উচিত ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও নীতিমালা অনুসরণ করা। ইটভাটার দূষণ পরাগায়নের প্রক্রিয়ায় বড় বাধা সৃষ্টি করে, যা কৃষিজ উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

ইটভাটা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি দুর্ভোগ

ইটভাটা শিল্পের প্রসার আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, এটি জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে আশপাশের এলাকার মানুষ, শ্রমিক ও শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য এটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা: ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া, ধূলিকণা ও ক্ষতিকর গ্যাস বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে, যা শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে।

অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিস: ধোঁয়া ও ধুলার কারণে ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি করে।

ফুসফুসের সংক্রমণ: বিষাক্ত গ্যাস ও ধূলিকণার কারণে শ্বাসনালিতে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা নিউমোনিয়া ও অন্যান্য ফুসফুসজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। চোখ ও ত্বকের সমস্যা। ইটভাটার ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস চোখে জ্বালা ও সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। ধূলিকণার কারণে ত্বকে চুলকানি ও অন্যান্য অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়।

কার্বন মনোক্সাইড ও বিষক্রিয়া: ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড (CO) বাতাসের সঙ্গে মিশে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে বাধা দেয়, যার ফলে মাথাব্যথা, দুর্বলতা ও বমি ভাব দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদে কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়া (Carbon monoxide poisoning) মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি: ইটভাটার বিষাক্ত বায়ু শিশুদের ফুসফুসের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে এবং জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়ায়। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এই দূষণ গর্ভপাত, অপরিণত শিশু জন্ম ও নবজাতকের শারীরিক দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে।

হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি: দীর্ঘ সময় বিষাক্ত বায়ুতে বসবাস করলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাতাসে থাকা সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইড রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে।

শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি: ইটভাটার শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন। তারা ভয়াবহ তাপমাত্রায় কাজ করেন, যা ডিহাইড্রেশন ও হিটস্ট্রোকের কারণ হয়। বিষাক্ত গ্যাস ও ধূলিকণা প্রতিনিয়ত শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেন, যা তাদের গড় আয়ু কমিয়ে দিতে পারে। সুরক্ষার অভাবে তারা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন।

সম্ভাব্য সমাধান: পরিবেশবান্ধব ইটভাটা প্রযুক্তি (Zigzag kiln, Hybrid Hoffman kiln) ব্যবহার করা। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আশপাশের এলাকায় বেশি গাছ লাগিয়ে দূষণ কমানো।

বিকল্প নির্মাণসামগ্রী (যেমন ব্লক ইট) ব্যবহারের প্রচলন বাড়ানো। ইটভাটার দূষণ প্রতিরোধ করা না গেলে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সরকার, মালিক ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবেশবান্ধব নীতিমালা অনুসরণ করাই একমাত্র সমাধান।

সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
[email protected]


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top