শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা : সম্প্রীতি এবং মানবতাবোধ
প্রকাশিত:
১১ মে ২০২৫ ১০:৪২
আপডেট:
১২ মে ২০২৫ ০৩:৩৫

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা, এটি বৌদ্ধদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় ও ধর্মীয় উৎসব। এ দিনটি বিশ্ববৌদ্ধদের নিকট অতি পবিত্র ও মহিমান্বিত দিন। ভগবান বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার বিশাখা নক্ষত্রে রাজকুমার সিদ্ধার্থ রূপে কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে আলোকপ্রাপ্ত অর্থাৎ সর্বতৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করে বোধিজ্ঞান লাভ করে জগৎ পূজ্য বুদ্ধ হয়েছিলেন।
বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। বুদ্ধের জীবনে মহাপবিত্র ত্রিস্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের নিকট অতি গৌরবের ও মহাপবিত্র দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। বিশ্ব বৌদ্ধরা একে বৈশাখ দিবস বা Vesak day হিসেবে উদযাপন করে। কারণ বৈশাখ মাসে সংগঠিত হয়েছিল বলে এটা বুদ্ধ পূর্ণিমা না বলে বৈশাখ দিবস বলে থাকে।
জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত United Nation day of Vesak হিসেবে ২০২৫ সালে বিশ্ব বৌদ্ধদের প্রতিনিধিদের নিয়ে ভিয়েতনামে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। ২৫৬৯ বুদ্ধবর্ষ ২০২৫ সালের বুদ্ধ পূর্ণিমা। বাংলাদেশের বৌদ্ধরাও নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এ পবিত্র দিবসটি উদযাপন করছে।
বুদ্ধবর্ষ গণনায় বৈশাখই প্রথম মাস। সেই হিসাবে বৌদ্ধ প্রধান দেশগুলোও তাদের পহেলা বৈশাখ বৈশাখের প্রথম দিনে উদযাপন করে। বিশেষত থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ভারতের কিছু কিছু প্রদেশ। বাংলাদেশও বৈশাখ মাসের প্রথম দিবসটি পহেলা বৈশাখ হিসেবে উদযাপন করে।
যদিও পহেলা বৈশাখের প্রর্বত্তক মোগল সম্রাট আকবর বলে ইতিহাসবিদরা মতামত দিলেও প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধের সময়কাল থেকেই বাঙালি জাতি বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে গণনা করতেন। তার কারণ এদেশে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে পাল রাজাদের ভূমিকা ছিল। পাল রাজা বাঙালি ও বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের চারশত বছরের অসাম্প্রদায়িক শাসন কালকে ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে।
মোগল সম্রাট আকবরও একজন অসাম্প্রদায়িক শাসক ছিলেন। তার আমলে যে যে অঞ্চলে জনহিতকর কার্যাবলী ছিল ও ভালো দিক তা গ্রহণ করেছিলেন। পহেলা বৈশাখ অসাম্প্রদায়িক ছিল বিধায় সম্রাট আকবর তা গ্রহণ করে ছিলেন। এটা বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের কারণে সমগ্র এশিয়ায় বৈশাখই বছর গণনায় প্রথম মাস। এটা বুদ্ধের জন্মোৎসবের কারণেই এ ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই ভগবান গৌতম বুদ্ধও একজন ঐতিহাসিক মহামানব হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃত।
শুধু বিশেষ আকার বা একটি কাঠামোর জন্য মানুষ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হন না। মানুষ হিসেবে আমাদের রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তি নামক বিশেষ একটি গুণ যার ধর্ম হলো যেকোনো বিষয়ে আমাদের আমার বিচারিক ক্ষমতা বা মূল্যায়নের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও পূর্বে এ ভূভাগে জন্ম নেওয়া তথাগত বুদ্ধ দাবি করেছিলেন সর্ব জীবের স্ব স্ব স্থানে স্বাধীন অবস্থান।
শুধু মাত্র মানুষের জন্য নয় তার মৈত্রী ভাব পৌঁছে গিয়েছিল দৃষ্টিগোচর হয় এবং দৃষ্টিগোচর হয় না এমন সব প্রাণীর কাছে। তাই তো তিনি বলেছিলেন—‘সব্বে সত্ত্বা সুখিতা হোন্তু’ অর্থাৎ, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। বোধের অমৃত অবগাহন হলে প্রাজ্ঞদের সবাই স্বীকার করেন, জাতপ্রথা, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বিভাজন নিষ্ফল, নিরর্থক!
বোধের বাতায়ন রুদ্ধ থাকার দরুণ অন্ধ প্রকোষ্ঠে মানুষ মানুষের সাথে, ধর্ম ধর্মের সাথে, গোত্র গোত্রের সাথে, পিতা পুত্রের সাথে, পুত্র পিতার সাথে, ভাই ভাইয়ের সাথে, বন্ধু বন্ধুর সাথে নানান স্বার্থের কারণে কলহরত। মহান বুদ্ধ বলেন, কলহে জর্জরিত অন্ধ মানুষ জানে না, সে নিজেই যেখানে নিজের নয়, অন্যর অধীনে বশ করতে চায় কী করে?
বুদ্ধের শিক্ষা পাঠোদ্ধার করলে দেখা যায়, জীব মাত্রই স্বাধীন। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয়ভাবে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই স্বাধীন অংশগ্রহণ, স্বতন্ত্র জীবন যাপনের অধিকার রাখে। এখানে কোনো বৈষম্য দেখা দিলে তা বুদ্ধধর্মের পরিপন্থী বলেই গণ্য হবে।
মানুষ হিসেবে আমাদের বাড়তি কিছু সুযোগ সুবিধা রয়েছে, শুধুমাত্র আত্ম স্বার্থ চরিতার্থ করাই নয়, অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের প্রতি সবিশেষ মনোযোগ, সৎ ও নিষ্ঠার সাথে পালনীয়। সর্বজীবের প্রতি মানবিক কর্তব্য পালনের জন্য কারো নির্দেশের অপেক্ষায় থাকাটাও অনেক সময় অমানবিক।
আমরা মানুষ হিসেবে, মানুষের কল্যাণে মঙ্গলকর কর্তব্য পালন করবো এটা মা, মাটি, মানুষের ধর্ম, এটা জগত ও জীবের প্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ ধর্ম। আমরা স্মরণ করতে পারি, এ বিষয়ে তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, ‘মা’ যেভাবে সব আপদ-বিপদ থেকে নিজের সন্তানকে অপার মৈত্রীবন্ধনে বুকে জড়িয়ে রাখে, রক্ষা করে, তোমরাও সেইরূপ মৈত্রীভাবে সব জীবের প্রতি পোষণ করো।
বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত জনবহুল একটি দেশ। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ আমাদের এই মাতৃভূমি। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কারণে আমাদের সামগ্রিক অবস্থায় বিশেষ প্রভাব রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে যদি দেখি বৌদ্ধরা কখনো ধর্মীয় উন্মাদনায় আস্থাশীল নয়, তারা জ্ঞানের বাহনে চড়ে এ জীবন যাপন করতে আগ্রহী। এ দেশ বৌদ্ধরা শাসন করে (পাল রাজাগণ) যাকে ঐতিহাসিকগণ বাংলার স্বর্ণযুগ বলেই মত দেন।
পালদের রাজত্বকালে সব ধর্মের সহাবস্থান বাংলার যেকোনো সময়কে ম্লান করে দিয়ে আজও সোনার মতো উজ্জ্বল্য ছড়াতে থাকে। আমরা বুদ্ধের এ কথা কখনো ভুলি না যে, কর্ম সু ও কু ফলদায়ী, যার যার কর্ম স্ব স্ব অবস্থানে ভোগ করবে। জীব মাত্রই কর্মের অধীন।
এমতাবস্থায় আমরা বিশেষ ধর্মের বাণী অথবা ব্যক্তিগত মতামত জোর করে, প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে কারও উপর প্রতিষ্ঠা করতে পারি না। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাখে যা মতামতের ভিত্তিতে খণ্ডনও করা যায়। আমি যেরূপ আমার নিজের মতো মতপ্রকাশ করতে পারি, করতে চাই অন্যেরও ঠিক একইভাবে তার মতো করে মত প্রকাশ করার একান্ত স্বাধীনতা শতভাগ রয়েছে। জ্ঞানদৃষ্টি বা মানবিক দৃষ্টিকোণ, যেখান থেকেই বলি না কেন দেখা যাচ্ছে যে, ধর্ম বা মতবাদ মানা না মানা ব্যক্তির স্বতন্ত্র ইচ্ছার উপর নির্ভর করে কিন্তু ভিন্ন ধর্ম, মত ও পথের মানুষের সহাবস্থান নিরাপদ, সুনিশ্চিত করতে হবে।
মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়াও এই ছোট্ট দেশটিতে রয়েছে নানা দেব-দেবীতে বিশ্বাসী অসংখ্য ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী যাদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা আলাদা কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, জীবনাচরণ ইত্যাদি। মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অন্যান্য সম্প্রদায় সেই প্রাচীন কাল থেকেই মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। মসজিদ, মন্দির, বিহার, গির্জার পাশাপাশি উপাসনালয় রয়েছে নানা ধর্মবিশ্বাসীদের।
হিন্দুদের মন্দিরে শাঁখ কিংবা কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ যেমন কখনো অন্যান্য ধর্মের লোকের কানে বেসুরো ঠেকেনি তদ্রুপ মুসলিমদের ইবাদত, বন্দেগী, আযানের ধ্বনিও ভিন্ন মতাবলম্বীর কানে বিকট ঠেকেনি। বৌদ্ধদের বন্দনা গীতি, খ্রিস্টানদের ভোজনা ও নৃত্যগীত যে কাউকেই প্রীত করে। পীড়িত করে এসবের মাঝে যখন অপ্রত্যাশিতভাবেই ঐক্যতানে ছেদ পড়ে, তখন আমরা বিপন্ন বোধ করি।
বাংলাদেশ বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষাভাষীর মিশ্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এক দেশ। পৃথিবীর বৃহত্তম এ ব-দ্বীপে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, প্রকৃতিপূজারী, নানা দেব-দেবীতে বিশ্বাসী অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীর মিলিত বসবাস রয়েছে প্রাচীন কাল থেকেই। অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এ জাতি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, আস্থা, বিশ্বাস, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, আতিথেয়তা বাঙালির অস্থিমজ্জায় গ্রোথিত। চিরায়িত বাংলার এটিই সাধারণ রূপ।
আমাদের ভুলে গেলে উচিত হবে না, এদেশের মানুষের কাছে নানান ধর্ম ও মতবাদ আসার আগেও আমাদের পূর্ব পুরুষরা ছিল, আমরা তাদেরই উত্তরাধিকারী হয়ে ধর্ম ও মতের বিভক্তিতে রক্ত আর সংস্কৃতির বিচ্ছেদ করতে পারি না। এটা যথাযোগ্য অনুধাবন না করতে পারলে কোন জাতি সে যতই সমৃদ্ধশালী হোক না কেন, সময়ের পরিক্রমায় ধ্বংস তার অনিবার্য। ভিন্ন মত ও পথের বিচিত্র, বৈচিত্র্য মানুষ পৃথিবীতে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতে থাকবে এটা স্বাভাবিক মেনেই সবার সাথে ভ্রাতৃত্বের, বন্ধুর বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে, এমন গুণাবলী-ই উত্তম ধর্ম মানুষের।
জগতের সব প্রাণী সুখী হোক, বুদ্ধ পূর্ণিমার পবিত্র দিনে সবার জন্য প্রার্থনা করি।
ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় ।। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন
[email protected]
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: