ভাটি অঞ্চলে বন্যার কারণ ও করণীয়
প্রকাশিত:
৫ জুন ২০২৫ ১২:২২
আপডেট:
৬ জুন ২০২৫ ১৯:৫২

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের জুন ২০২৫-এর দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে যে, দেশের সামগ্রিক বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক থাকলেও ১-২টি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ৬ থেকে ৮ দিন বজ্রঝড় হতে পারে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলের ফলে প্রতিবছর বন্যা দেখা দেয়। সর্বশেষ পূর্বাভাস ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ময়মনসিংহ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং রংপুর জেলার নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারি প্রস্তুতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রস্তুতিও অত্যন্ত জরুরি। নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের উঁচু স্থানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা, জরুরি ওষুধ, শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। পশুসম্পদের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। এখনই সময় সতর্ক হওয়ার, যাতে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।
উজান ও ভাটির প্রভাব:
উজান হলো, যেখানে নদীর উৎপত্তি বা পাহাড়ি এলাকা, অর্থাৎ নদীর ঊর্ধ্বপ্রবাহ এবং ভাটি হলো, নদীর নিম্নপ্রবাহ বা যেখানে নদী সমুদ্রে মিশে যায়। উজান ভাটির কারণে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশেই নির্ভর করে।
উজানের কারণে বন্যা: উজানে (যেমন ভারত বা নেপালের পাহাড়ি অঞ্চল) অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ি ঢল নামে। এই পানি নেমে আসে নিচু ভাটির দিকে (যেমন, বাংলাদেশ)। যদি নদীর ধারণক্ষমতা কম থাকে বা যদি নদীভরাট বা অব্যবস্থাপনার কারণে পানি সরাতে না পারে, তাহলে নদী উপচে বন্যা হয়। হঠাৎ ঢলের কারণে আকস্মিক বন্যা (flash flood) হয়, যা উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে বেশি দেখা যায় (যেমন সিলেট, সুনামগঞ্জ)।
ভাটির কারণে বন্যা: ভাটির দিকে যদি জোয়ার বা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায় (বিশেষ করে বর্ষাকালে), তাহলে নদীর পানি সাগরে নামতে পারে না। ফলে নদীতে পানি আটকে যায় এবং তা উজানের দিকে ফিরে গিয়ে বন্যা সৃষ্টি করে। উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় এই ধরনের ভাটি সংক্রান্ত বন্যা হয় (যেমন বরগুনা, পটুয়াখালী)।
উজান ও ভাটির মিলিত প্রভাব: যদি একইসাথে উজানে অতিবৃষ্টি হয় এবং ভাটিতে জোয়ারের পানি থাকে, তাহলে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে যায়। এই ধরনের যৌথ প্রভাবে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে।
নাব্যতা, পানি প্রবাহ এবং ভাটি অঞ্চলে বন্যার প্রভাব:
নাব্যতা : নাব্যতা বলতে বোঝায় কোনো নদী বা জলপথে জলযান চলাচলের উপযোগিতা। এটি নির্ভর করে নদীর গভীরতা, প্রস্থ এবং নিচের তলদেশে পলি বা বালি জমার মাত্রার উপর। নদীতে পলি জমা হলে নাব্যতা হ্রাস পায়। পানি নদীর তলদেশে জমে থাকতে পারে, ফলে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে না পেরে প্লাবন হয়। নাব্যতা কমে গেলে বাণিজ্যিক নৌ চলাচল ব্যাহত হয় এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পরিবর্তিত হতে পারে। চ্যানেল পরিবর্তন বা সংকোচন হলে, প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে ভাটিতে পানি জমে গিয়ে বন্যা সৃষ্টি হয়।
প্রবাহ চ্যানেল: প্রবাহ চ্যানেল হচ্ছে নদীর সেই অংশ যেখানে পানি প্রবাহিত হয়। এর গঠন নির্ভর করে ভূমির ঢাল, মাটি বা পাথরের গঠন এবং পানির পরিমাণের ওপর। প্রাকৃতিক কারণে বা মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ (যেমন বাঁধ নির্মাণ বা ড্রেজিং না করা) প্রবাহ চ্যানেলের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
চ্যানেল সংকুচিত হলে পানি দ্রুত নির্গত হতে পারে না এবং উপরের বা নিচের দিকে পানি জমে যেতে পারে। জোয়ার-ভাটার প্রভাবে ভাটি এলাকায় জোয়ারের সময় পানি উপরে উঠে আসে, আর যদি নদীর চ্যানেল সংকীর্ণ বা নাব্যতা কম হয়, তাহলে পানি ঠিকমতো সরে যেতে পারে না প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং বন্যা হয়।
ভাটি অঞ্চল: ভাটি অঞ্চল হচ্ছে নদীর নিম্নপ্রবাহ বা মোহনার দিকের এলাকা। এই অঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।
বন্যা মোকাবিলায় নদী শাসন ও পানি প্রবাহ:
নদী শাসন জন্য নদীর খনন ও পুনঃখনন করা; নদীর প্রাকৃতিক গভীরতা ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে। চারণভূমি ও চরগুলো নিয়ন্ত্রণ করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা; নদী তীর সংরক্ষণ করা; নদীতীর ভাঙন রোধে গাইড বাঁধ; জিওব্যাগ, কংক্রিট ব্লক ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। গাছপালা রোপণ ও ভেজিটেশন দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে তীর শক্তিশালী করা; বাঁধ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা; বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করা; অস্থায়ী বাঁধ বা স্যান্ড ব্যাগ ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে হবে।
পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে যা করতে কবে, অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা; নদী ও খাল দখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনা অপসারণ; পানি চলাচলের পথ উন্মুক্ত রাখা; পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন করা; ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নিয়মিত পরিষ্কার; শহর ও গ্রামে খাল ও ছোট নদীগুলো সংরক্ষণ এবং দখল মুক্ত করা; জলাধার ও খাল পুনরুদ্ধার করা; খাল, বিল, পুকুর সংরক্ষণ ও পুনঃখননের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়া নীতিমালা ও সচেতনতা তৈরি করা; সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা একাধিক জেলার নদীগুলোর ওপর একসাথে পরিকল্পনা গ্রহণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা; স্থানীয় মানুষকে নদীর প্রয়োজনীয়তা ও বন্যা ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করা; আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা; স্যাটেলাইট চিত্র, ড্রোন ও সেন্সর ব্যবহার করে নদী ও পানির গতিপথ পর্যবেক্ষণ জরুরি।
মৌসুমি বন্যা মোকাবিলায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা:
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ সতর্কীকরণ ব্যবস্থা জোরদার করা; বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা দ্রুত ও কার্যকরভাবে জনগণের কাছে পৌঁছানো; মোবাইল এসএমএস, রেডিও, টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে সতর্কতা ছড়ানো; জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা; স্কুল, কলেজ বা অন্য সরকারি স্থাপনাগুলো অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা; সেখানে খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা করতে হবে।
নদী ও ড্রেন পরিষ্কার করা; জলাবদ্ধতা রোধে শহর ও গ্রামাঞ্চলের খাল-বিল, ড্রেনেজ ব্যবস্থা দ্রুত পরিষ্কার করা; পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখা; স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ও প্রশিক্ষণ; স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, যারা উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে সহায়তা করবে; ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রস্তুতি; খাদ্য, ওষুধ, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন সামগ্রী মজুত রাখা; আক্রান্তদের দ্রুত সহায়তা পৌঁছাতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: টেকসই বাঁধ ও নদীতীর সংরক্ষণ করা; নদীর পাড়ে শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ ও পুরাতন বাঁধগুলোর সংস্কার; নদীশাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন; নদী খনন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা; নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত খনন; শহরাঞ্চলে আধুনিক ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরি করা; আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষণা জোরদার করা; আধুনিক আবহাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে আগাম পূর্বাভাসের দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি।
জলাভূমি ও প্রাকৃতিক বন্যা ভূমির সংরক্ষণ করা; জলাধার, হাওর-বাওর, বিল ও খাল সংরক্ষণ করে অতিরিক্ত পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি; নগর পরিকল্পনা ও জনবসতি ব্যবস্থাপনা করা; বন্যাপ্রবণ এলাকায় নতুন বসতি ও অবকাঠামো নির্মাণ সীমিতকরণ; বিকল্প উঁচু জায়গায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা; জনসচেতনতা ও শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ; স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটিতে দুর্যোগ সচেতনতা বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা; স্থানীয় জনগণকে বন্যার ঝুঁকি ও করণীয় সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
নাব্যতা হ্রাস, প্রবাহ চ্যানেলের সংকোচন বা ভরাট এবং জল প্রবাহের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হলে ভাটি অঞ্চলে বন্যার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তাই নিয়মিত ড্রেজিং, প্রবাহ চ্যানেলের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিবেশসম্মত নদী ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং ভাটিতে আটকে থাকা পানির কারণে বন্যা হয় এবং এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। সুষ্ঠু নদী ব্যবস্থাপনা, বাঁধ নির্মাণ, এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয় (যেমন, ভারত-বাংলাদেশ পানি চুক্তি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সমস্যার মোকাবিলায়।
সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
[email protected]
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: