ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে লাল মরিচের অস্থায়ী হাটে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি
প্রকাশিত:
১৮ জুন ২০২৫ ১৪:২৪
আপডেট:
১৮ জুন ২০২৫ ১৮:১২

ভোরের আলো ফুটতেই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একের পর এক ভেসে আসে নৌকা। নৌকায় সাদা বস্তার ভেতর গায়ে গায়ে ঠাসা টকটকে লাল মরিচ—যেন আগুনঝরা কোনো শস্যের উৎসব! গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার পুরাতন হেডকোয়ার্টার এলাকায় বসা মরিচের এই হাট যেন শুধু বেচাকেনার জায়গা নয়, এটি হয়ে উঠেছে জীবন-জীবিকার এক চিরচেনা কেন্দ্র।
তবে ব্যাবসায়ীদের অভিযোগ রয়েছে, এই হাটে বছরের পর বছর ধরে কোটি টাকার লেনদেন হলেও হাটের নেই স্থায়ী কোনো ঠিকানা। বসতে হয় ভাড়া করা জায়গায়। নেই বিশ্রামাগার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উপজেলা প্রশাসন বলছে, খুব দ্রুতই একটি উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে হাটের পরিবেশ উন্নত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও সদর—এই চার উপজেলার শতাধিক চরজুড়ে বছরের পর বছর ধরে চাষ হয় শুকনা মরিচ। কৃষকরা বলেন, মাটি যেমন উর্বর, তেমনি নদীর পানি দেয় জীবনীশক্তি। মরিচের গায়ে যেন সেই ঋতুর স্পর্শ! আর চরের ফসলের গন্তব্য হলো এই হাট।
সপ্তাহে দুই দিন—শনিবার ও মঙ্গলবার সকাল থেকেই শুরু হয় ব্যস্ততা। নদীপথে ভেসে আসেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। কেউ মাথায় বস্তা নিয়ে, কেউবা ঘোড়ার গাড়িতে বোঝাই মরিচ এনে হাজির হন হাটে।
ঘাটে পা দিলেই মনে হবে—এটি কোনো মেলা! পাড়ে ভিড়ছে নৌকা, নিচ্ছে মরিচভর্তি বস্তা। চোখে-মুখে ঘাম ও স্বপ্ন নিয়ে নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও হাত লাগাচ্ছে মরিচ নামানোর কাজে।
একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে হাঁটছিলেন খোলাবাড়ি গ্রামের কৃষক সাদেকুল। মুখে ক্লান্তি, কিন্তু তাতে গর্বও মেশানো। বললেন, চার বিঘা জমিতে মরিচ করেছিলাম, ফলন ভালো। দামটা আরেকটু ভালো হলে চরের লোকজন হাঁফ ছেড়ে বাঁচত।
হাটজুড়ে কেবল দামদর নয়, আলোচনায় উঠে আসে মরিচের মান। মান ভেদে তিন ভাগে ভাগ—উত্তম, মধ্যম, নিম্ন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, ফুলছড়ির মরিচ মানে একরকম গ্যারান্টি। প্যাকেটজাত খাবারের কোম্পানিরাও এখান থেকে সরাসরি মরিচ কিনে নিয়ে যায়।
নওগাঁ থেকে আসা ব্যবসায়ী শাহা পরাণ সুলতান বললেন, আমি গত ১০ বছর ধরে এই হাটে মরিচ কিনছি। দেশের অন্য কোথাও এত ভালো মানের শুকনা মরিচ পাইনি।
তবে এতে ভালো মানের মরিচের বাজারদর কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। রতনপুরের আজগর আলী বলেন, গত বছর বিক্রি করেছি ১২ হাজারে, এবার পাইকাররা বলছে ৫ হাজার! এত কম দামে আমরা কীভাবে খরচ তুলব?
শুধু আজগর নন, হাটজুড়ে কৃষকের মুখে একই সুর—ফলন ভালো, দাম খারাপ। বছরের পর বছর ধরে কোটি টাকার লেনদেন হলেও হাটের নেই স্থায়ী কোনো ঠিকানা। বসে ভাড়া করা জায়গায়। নেই বিশ্রামাগার, নাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ফুলছড়ি হাটের ইজারাদার অহিদুল ইসলাম বললেন, এখানে সরকারি খাস জমি রয়েছে। চাইলে ভরাট করে হাটসেড, গোডাউন, শৌচাগার বানানো সম্ভব। তাতে ব্যবসায়ীরাও সুবিধা পাবেন, সরকারও রাজস্ব পাবে।
পাইকাররাও একই কথা বলছেন। বগুড়া থেকে আসা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, রাতে থাকি কোথায়? হাটে ঘুমানোর জায়গা নেই। অথচ লাখ লাখ টাকার লেনদেন করি আমরা।
এ বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জগৎবন্ধু মন্ডল বলেন, ফুলছড়ির মরিচের হাট গাইবান্ধার ঐতিহ্যবাহী একটি হাট। তা ছাড়া মরিচ গাইবান্ধার একটি ব্র্যান্ড পণ্য। কৃষকের ঘামের এই পণ্যের সঠিক মূল্য নিশ্চিতে আমরা বদ্ধপরিকর। খুব দ্রুতই একটি উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে হাটের পরিবেশ উন্নত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ফুলছড়ির এই মরিচ শুধু রান্নাঘরের রঙ বা স্বাদের জিনিস নয়। এটি হাজারো কৃষক পরিবারের রুজি-রুটি জোগানোর উৎস, জীবন এগিয়ে নেওয়ার সাহস। তাদের চাষ, সংগ্রাম ও শ্রমে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই মরিচ বাজার। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হাটের রূপ বদলাতে পারে, কৃষকের ঘরে ফিরতে পারে প্রত্যাশার আলো।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: