জিডিপি নামতে পারে ৬ শতাংশে
ট্রাম্পের শুল্কাঘাতে ভারতীয় অর্থনীতিতে বিশাল ধাক্কার শঙ্কা
প্রকাশিত:
৭ আগস্ট ২০২৫ ১৭:২৭
আপডেট:
৭ আগস্ট ২০২৫ ২০:০৪

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করায় ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন ভারতের রপ্তানিকারকরা। রাশিয়ার তেল আমদানির জরিমানা হিসেবে ট্রাম্প অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের একদিন পর বৃহস্পতিবার দেশটির ব্যবসায়ীরা এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ট্রাম্পের শুল্কাঘাতের পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘‘আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বড় মূল্য দিতে হবে এবং আমি এ জন্য প্রস্তুত।’’ অন্যদিকে, দেশটির বিরোধীদল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী এই শুল্ককে ‘অর্থনৈতিক ব্ল্যাকমেইল’ এবং ‘ভারতের ওপর অন্যায্য বাণিজ্য চুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা’ বলে মন্তব্য করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পর বৃহস্পতিবার ভারতের শেয়ারবাজারে সামান্য পতন দেখা গেছে। ভারতীয় পণ্যে আগের ২৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক বৃহস্পতিবার থেকেই কার্যকর হওয়ায় দিনের শুরুতে শেয়ারের সূচক ০ দশমিক ৩১ শতাংশ কমে যায়।
ট্রাম্প বুধবার অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করায় ভারতীয় পণ্যে মোট শুল্ক তিন সপ্তাহ পর দ্বিগুণ হবে। ভারত ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাশিয়ার জন্য বড় রাজস্ব উৎস হয়ে ওঠা তেল কেনা অব্যাহত রাখায় ওই শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে রাশিয়ার তেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা ভারত। দেশটির কাছ থেকে কম দামে তেল কিনে বিপুল অর্থ সাশ্রয় করছে নয়াদিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের অতিরিক্তি শুল্খ আরোপের পদক্ষেপকে ‘‘অন্যায্য, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য’’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
ভারতীয় রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের সভাপতি এস.সি. রালহান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের ভয়াবহ প্রভাবের বিষয়টি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘‘এই পদক্ষেপ ভারতীয় রপ্তানির জন্য বড় ধাক্কা। মার্কিন বাজারে আমাদের রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ সরাসরি প্রভাবিত হবে।’’
‘৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আমাদের রপ্তানিকারকদের ওপর অতিরিক্ত ব্যয় চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অন্য দেশগুলোর তুলনায় ৩০–৩৫ শতাংশ পিছিয়ে পড়ছে ভারত।’
রালহান বলেন, ইতোমধ্যে অনেক রপ্তানি আদেশ স্থগিত করা হয়েছে। কারণ ক্রেতারা পণ্যের নতুন উৎসের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। তিনি বলেন, ‘‘দেশের অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার লাভের পরিমাণ আগে থেকেই অনেক কম। হঠাৎ করে এই ব্যয়বৃদ্ধি বহন করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’’
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি ও সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কের প্রভাব মোকাবিলায় বর্তমানে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভারতের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ভারত।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের শীলান শাহ এক নোটে বলেছেন, ‘‘ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপিত অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক যদি বহাল থাকে, তাহলে ভারতকে একটি উদীয়মান উৎপাদন হাব হিসেবে দেখাটা ভয়াবহভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।’’
তিনি বলেন, ভারতের জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে। ভারতীয় পণ্যের রপ্তানিতে প্রভাব ফেলার জন্য ৫০ শতাংশ শুল্ক অনেক বড় আঘাত। এর ফলে রপ্তানি হ্রাস পেলে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ থেকে নেমে চলতি বছর ও পরের বছরে ৬ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে, স্মার্টফোন, ওষুধ, রত্নপাথর, টেক্সটাইল ও বিভিন্ন ধরনের শিল্পখাতের যন্ত্রপাতি। এর মধ্যে সবচেয়ে শ্রমনির্ভর গয়না ও সামুদ্রিক খাদ্য খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে।
বুধবার ভারতের সামুদ্রিক খাদ্য রপ্তানিকারক সংস্থা বলেছে, ৫০ শতাংশ শুল্ক তাদের ৩ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসাকে ‘‘বিপন্ন’’ করে তুলেছে। ভারতের গয়না খাত থেকেই গত বছর কেবল ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করা হয়েছিল। আগের কম শুল্ক সুবিধা থাকার পরও দেশটিতে এই খাতের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। বর্তমানে এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ হারের শুল্ককে ‘‘ধ্বংসাত্মক’’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে ভারতের কৃষিখাতে। দেশটির কোটি কোটি মানুষ সরাসরি এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি খাতকে পুরোপুরি মার্কিন আমদানির জন্য উন্মুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ভারত।
বৃহস্পতিবার এক ভাষণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভারত কখনই তার কৃষকদের স্বার্থ নিয়ে আপস করবে না। তিনি বলেন, আমাকে হয়তো ব্যক্তিগতভাবে বড় মূল্য দিতে হবে। কিন্তু আমি তার জন্য প্রস্তুত। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানাননি তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের বিষয়ে ভারত প্রাথমিকভাবে যে বিশেষ শুল্ক সুবিধার আশা করেছিল, ট্রাম্পের পদক্ষেপ ঠিক তার বিপরীত বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প বলেছিলেন, ওয়াশিংটন সফরের সময় তিনি মোদির সঙ্গে ‘বিশেষ বন্ধন’ অনুভব করেছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের গত কয়েকটি প্রশাসন। যাদের চীনের বিষয়ে ভারতের মতো একই ধরনের কৌশলগত আগ্রহ ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে ভারত ও চীন।
ভারতীয় গণমাধ্যম বলেছে, চলতি মাসের শেষের দিকে দীর্ঘদিনের চিরবৈরী প্রতিদ্বন্দ্বী চীন সফরে যেতে পারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও সরকারিভাবে এই সফরের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত করা হয়নি। তবে ২০১৮ সালের পর প্রথমবারের মতো মোদি চীন সফরে যাচ্ছেন বলে দেশটির সংবাদমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সর্বশেষ ২০২৪ সালের অক্টোবরে রাশিয়ায় স্বাক্ষাৎ করেছিলেন।
সূত্র: এএফপি।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: