বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলীগকে ‘ধর্মীয় পর্যটন’ ঘোষণা করতে নোটিশ
প্রকাশিত:
৩০ জুলাই ২০২৩ ২০:৩০
আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:০০

বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলীগকে ‘ধর্মীয় পর্যটন’ ঘোষণা এবং কাকরাইলে তাবলীগের মারকাজ মসজিদে সরকারি প্রশাসক নিয়োগের দাবিতে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
রোববার (৩০ জুলাই) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান এ নোটিশ পাঠান।
ধর্ম মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও কাকরাইলে তাবলীগের মারকাজ মসজিদের প্রধানকে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ হলো পবিত্র হজ। প্রতি বছর হজের নির্ধারিত সময় ছাড়াও সারাবছর বিশ্বের মুসলিমরা উমরাহ পালন করে থাকে। উক্ত হজ ও উমরাহ থেকে সৌদি আরব বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে। বিশ্বের অন্যতম সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে এক বছরেই সৌদি আরব হজ ও উমরাহ থেকে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক লাখ বত্রিশ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসেবে)।
সারাবিশ্বে মুসলমানদের জন্য হজের পর দ্বিতীয় মহাসম্মেলন হলো বিশ্ব ইজতেমা। এছাড়া সারা বছর তাবলীগ কার্যক্রমের নিয়ম আছে। ওই বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলীগের কার্যক্রমে ব্যাপক সংখ্যায় বিদেশি মুসলিম পর্যটকদের আকৃষ্ট করে বাংলাদেশে আনতে পারলে বাংলাদেশ প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে এবং বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হবে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা, উপমহাদেশীয় ষড়যন্ত্র এবং কিছু ধর্মীয় নেতাদের পারস্পরিক হিংসাত্মক দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশে তাবলীগের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। যার কারণে বিশ্ব ইজতেমা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এতে করে সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ এই অপার সম্ভাবনাময় ‘ধর্মীয় পর্যটনের’ অর্থনৈতিক সুযোগকে কাজে লাগাতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং মুসলিম বিশ্বে শক্তিশালী প্রভাব অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। বাংলাদেশের পক্ষে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো অবাধ যৌনতা, বিকিনি, অ্যালকোহল, ক্যাসিনো ভিত্তিক পর্যটন খাত তৈরি করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ধর্মীয় পর্যটন বাংলাদেশের একটি ব্যাপক সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশ যদি প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষ্যে কমপক্ষে দশ লাখ বিদেশি মুসলিম পর্যটক বাংলাদেশে আনতে পারে তাহলে এর মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশ কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। এছাড়া এসব মুসলিম পর্যটকরা বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করবেন যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হবে এবং সারা মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্যের প্রচার, প্রসার ও চাহিদা তৈরি হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া তাবলীগের কার্যক্রম যেহেতু সারাবছর চলমান থাকে তাই বিপুল সংখ্যক বিদেশি মুসলিম পর্যটকদের আগমনে বাংলাদেশের অর্থনীতি সারাবছর উপকৃত হবে।
বাংলাদেশে এই ব্যাপক সম্ভাবনাময় ধর্মীয় পর্যটনে প্রধান বাধা সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ও প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা এবং কিছু ধর্মীয় নেতাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও মানসিকতা। বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা ও আলেমরা ধর্মচর্চার পরিবর্তে রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা ও আলেমরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার চেয়ে মানুষের কাছ থেকে উপহার, দান বাবদ অর্থ নিতে বেশি আগ্রহী। এছাড়া অধিকাংশ মসজিদের ইমামরা মানুষের কাছে ইসলামের ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বক্তৃতা বা বয়ান করার পরিবর্তে দান খয়রাতের উপকারিতার ব্যাপারে বক্তৃতা বা বয়ান করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এভাবে আমাদের অর্থনীতিতে একটি দুষ্টচক্রের আবির্ভাব হয়েছে। অথচ সব নবী রাসুলরা নিজস্ব পেশা অবলম্বন করতেন এবং উপার্জন করতেন।
বিশ্বের সব দেশ তাদের পর্যটন সেক্টরকে সবসময় সব ধরনের রাজনীতি থেকে দূরে রাখে। যেমন ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে সবসময় সংঘাতময় পরিস্থিতি থাকলেও ভারত সরকার সেখানে পর্যটনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। কাশ্মীরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধের প্রস্তুতিতে দাঁড়িয়ে থাকে এবং শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধের সাঁজোয়াযান নিয়ে কাশ্মীরের শ্রীনগরের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে অবস্থান নেয়। কাশ্মীরে সবসময় যুদ্ধাবস্থার পরিবেশ থাকলেও সেখানে বিদেশি পর্যটকরা নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করতে পারে।
অপরদিকে বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতময় অঞ্চল হলো ইসরায়েল অধিকৃত জেরুজালেমে অবস্থিত আল আকসা মসজিদ। এই আল আকসা মসজিদ নিয়ে সারাবছরই ইহুদি ও ফিলিস্তিনি মুসলিমদের সংঘর্ষ লেগেই থাকে। এত সংঘাত সত্ত্বেও ইসরায়েল সরকার বিদেশি পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয় আল আকসা মসজিদ ভ্রমণ করতে।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের সব দেশ তাদের পর্যটনকে সব প্রকার রাজনীতি থেকে দূরে রাখে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশে ধর্মীয় পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এখানে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি ঢুকে গেছে। বাংলাদেশে তাবলীগে ‘মাওলানা সাদ’ ও ‘মাওলানা জোবায়ের’ নামে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। এই দুই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাবলীগের কার্যক্রমের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে এবং বিশ্ব ইজতেমা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, তাবলীগের ভারতীয় আমির মাওলানা সাদের কিছু ব্যক্তিগত বক্তব্যের কারণে বাংলাদেশের কাকরাইলে তাবলীগের মারকাজ মসজিদের কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বাংলাদেশের সংবিধান, ভারতীয় সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তির তার মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে একে অপরের মধ্যে মতবিরোধ থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। পাশাপাশি সব ধরনের সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করা উচিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা ও আলেমরা মানুষকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা শিক্ষা দিলেও নিজেরাই এসব মানেন না। ফলশ্রুতিতে দুই গ্রুপের উদ্ভব হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের এই ধর্মীয় পর্যটন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের বদনাম হচ্ছে। এমতাবস্থায় দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থে কাকরাইলে তাবলীগের মারকাজ মসজিদে অবিলম্বে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ করা আবশ্যক।
‘তাবলীগ’কে অবশ্যই সব ধরনের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। তাবলীগের মূল কাজ হলো মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধর্মের প্রতি আহ্বান করা। এসব কাজকে অবমূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। হযরত মূসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) বা যিশু খ্রিষ্ট, হযরত মোহাম্মদ (স.) সহ সব নবী রাসুলরা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ধর্মের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ধর্মের প্রতি আহ্বান করাই ছিল সব নবী রাসুলদের প্রধান কাজ। এটা সম্পূর্ণ পবিত্র কাজ। এখানে রাজনীতির কোনো স্থান নেই। তাই এই তাবলীগের কার্যক্রমকে সব ধরনের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে এবং তাবলীগের ভেতরে সব ধরনের দলাদলি বা গ্রুপিং নিষিদ্ধ করতে হবে। এক বা একাধিক ব্যক্তির বিরোধের কারণে তাবলীগের কার্যক্রমে কোনোপ্রকার বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। সৌদি আরবের সরকার যেমন ‘হজ ও উমরাহ’কে বিশেষ প্রটেকশন দিয়ে থাকে, তদ্রূপভাবে বাংলাদেশের সরকারকে ‘বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলীগ’কে বিশেষ প্রটেকশন দিতে হবে কারণ হজের পরই সারা বিশ্বের মুসলিমদের দ্বিতীয় মহাসমাবেশ হলো বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশের সরকারকে অবশ্যই ‘বিশ্ব ইজতেমা’ ও ‘তাবলীগ’কে সব ধরনের দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র থেকে নিরাপদ রাখতে হবে।
এছাড়া বিশ্ব ইজতেমাকে বিদেশি মুসলিম পর্যটকদের বা মেহমানদের জন্য আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক করতে হবে। গাজীপুরের টঙ্গীর ঘিঞ্জি এলাকার পরিবর্তে কক্সবাজারে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশিরা যাতে সরাসরি বা ট্রানজিট ফ্লাইটে কক্সবাজারে সহজেই যেতে পারে সে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এছাড়া বছরের যে সময় কক্সবাজারের আবহাওয়া অনুকূলে থাকে সেই সময়ে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন করতে হবে। বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিদেশি মুসলিম মেহমানরা যাতে কক্সবাজারের বিভিন্ন পর্যটন স্পট, সমুদ্র সৈকত অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারে এবং কেনাকাটা করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বছরের এই নির্দিষ্ট কিছুদিন কক্সবাজারে সব হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলোতে যাতে বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী বিদেশি মুসলিম মেহমানরা ভালোভাবে অবস্থান করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য পৃথক তারিখে ইজতেমার সময় নির্ধারণ করতে হবে যাতে বিদেশি মুসলিম মেহমানদের কোনো সমস্যা না হয়। এছাড়া বাংলাদেশে তৈরি বিশ্বমানের গার্মেন্টস ও বিভিন্ন পণ্য যাতে বিদেশি মুসলিম মেহমানরা ন্যায্য দামে কিনতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
নোটিশ পাওয়ায় ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই ‘বিশ্ব ইজতেমা’ ও ‘তাবলীগ’কে ধর্মীয় পর্যটন ঘোষণা করতে হবে এবং সব ধরনের ষড়যন্ত্র, রাজনীতি ও গ্রুপিং থেকে রক্ষা করতে হবে এবং অবিলম্বে কাকরাইলে তাবলীগের মারকাজ মসজিদে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে। অন্যথায় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: