শঙ্কার নতুন নাম ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড
প্রকাশিত:
২৬ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৫১
আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:১৮

রোগটির নাম টাইফয়েড জ্বর। কিন্তু জ্বর বাদ দিয়ে শুধু টাইফয়েড নামেই রোগটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। টাইফয়েড মানুষের চেনাজানা প্রাচীন রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৪৩১ বছর আগে গ্রিস ও স্পার্টা রাজ্যের মধ্যে পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধ (Peloponnesian War) নামের একটি বিখ্যাত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেসময় এথেন্সে একধরনের জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটে যাকে 'এথেন্স প্লেগ (Plague of Athens)' বলা হতো।
আধুনিক কালে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গিয়েছে এথেন্স প্লেগ আসলে প্লেগ নয় টাইফয়েড জ্বর ছিল। একধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে টাইফয়েড হয়। ব্যাকটেরিয়াটির একটি বড়সড় নাম থাকলেও সংক্ষিপ্ত রূপে একে ‘সালমোনেলা টাইফি (Typhoid Fever)’ বলা হয়।
মূলত এই টাইফি থেকে টাইফয়েড শব্দের উৎপত্তি। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের পরিপাকতন্ত্রের ভেতর বসবাস ও বংশবৃদ্ধি করে। মানুষের মলের সাথে মিশে শরীর থেকে বের হয়ে আসে। মল থেকে বিভিন্ন উপায়ে পানির সাথে মিশে খাবার পানি, নানারকম পানীয় বা খাদ্যের সাথে মানুষের শরীরের প্রবেশ করে।
পানির মাধ্যমে ছড়ায় বলে টাইফয়েডকে পানিবাহিত রোগ বলা হয়। সালমোলেনা টাইফি শরীরে প্রবেশের ৬ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ শুরু হয়। প্রথমদিকে অল্প জ্বর যা ক্রমশ ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে। জ্বরের সাথে শারীরিক দুর্বলতা, পেট ব্যথা, বমি, কোষ্ঠকাঠিন্য, পাতলা পায়খানা, শরীরে ফুসকুড়ি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসার প্রধান ওষুধ হচ্ছে কয়েক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। সাধারণভাবে এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো টাইফয়েডের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ কার্যকর। মুখে খাওয়ার ওষুধ ১০ থেকে ১৪ দিন ব্যবহার করার মাধ্যমে এই রোগের নিরাময় ঘটে।
অনেকদিন যাবৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করছে টাইফয়েডের জীবাণু সালমোলেনা টাইফির বিরুদ্ধে কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে, কোনো ক্ষেত্রে এটি শূন্যে নেমে গিয়েছে।
এর সরল অর্থ হচ্ছে, টাইফয়েডের জীবাণু ক্রমশ ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক সুবিখ্যাত ‘দ্য ল্যানসেট মাইক্রোব’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকসহ সচেতন সাধারণ মানুষের মনে বিপদ ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে।
একদল গবেষক নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত এই চারটি দেশ থেকে (২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত) টাইফয়েড রোগীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। সেইসব নমুনা থেকে নেওয়া ৩৪৮৯টি সালমোলেনা টাইফি-র জিন বিন্যাস বিশ্লেষণ করা হয়। এর সাথে বৈশ্বিকভাবে সংগৃহীত ৪১৬৯ (১৯০৫-২৯১৮ পর্যন্ত সংগৃহীত)টি জিন বিন্যাস যুক্ত করে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করে। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল একটি গুরুতর বিপদের নির্দেশ দেয়।
গবেষণায় দেখা যায় নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের টাইফয়েড জীবাণুর একটি বিশেষ ধরণ বেশিরভাগ অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে। এর সোজা অর্থ হচ্ছে, টাইফয়েড রোগীর চিকিৎসায় যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হতো সেগুলোর অধিকাংশ এখন টাইফয়েড নিরাময়ে কাজ করছে না। টাইফয়েড জীবাণু সেসব অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে।
ঘটনাটি কেবল এই চারটি দেশে সীমাবদ্ধ নেই। এ অঞ্চল থেকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী বিশেষ ধরনের টাইফয়েড জীবাণু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে বা রপ্তানি করা হয়েছে। এরকম ছড়িয়ে পড়ার ২০০ (১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত) ঘটনা গবেষক দল শনাক্ত করেছে। বিপদজনক এই জীবাণু বেশি ছড়িয়েছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোয়। তবে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো দেশগুলোয় রপ্তানিকৃত সালমোলেনা টাইফির অস্তিত্ব শনাক্ত করা গিয়েছে।
টাইফয়েডের জীবাণু একটি বা দুটি নয়, বহু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এজন্য এই জীবাণুকে বহু-ওষুধ প্রতিরোধী রোগ-জীবাণু বলা হচ্ছে। বহু-ওষুধ প্রতিরোধী সালমোলেনা টাইফির উত্থান যেমন দ্রুত ঘটছে তেমনই দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে। ২০১৬ সালে পাকিস্তানে এই বিশেষ ধরনের টাইফয়েড জীবাণু শনাক্ত হয়। মাত্র তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৯ সালেই এটি পাকিস্তানের টাইফয়েড জীবাণুর প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে।
অন্যান্য দেশেও এই গতিধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বহু-ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড জীবাণুর উত্থান ও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে? যে গতিতে টাইফয়েডের এই ধরনটি অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে তা চলমান থাকলে জীবাণুটি সব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী উঠতে তেমন সময় নেবে না।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, তাহলে কি বিশ্ব একটি সর্ব-ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড জীবাণুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে? নতুন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে টাইফয়েড নামের প্রাচীন ঘাতক কি আবার পৃথিবী মঞ্চে আবির্ভূত হবে?
চিকিৎসা না পেলে ২০ শতাংশের মতো টাইফয়েড রোগী মৃত্যুবরণ করে। বিপুল সংখ্যক রোগী মৃদু থেকে তীব্র জটিলতার স্বীকার হয়। বিপুলসংখ্যক রোগী টাইফয়েডের জীবাণুবাহকে রূপান্তরিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, টাইফয়েড একটি সম্পূর্ণ নিরাময় যোগ্য রোগ। টাইফয়েড চিকিৎসার জন্য শতভাগ কার্যকর মুখে খাওয়ার ও ইনজেকশন হিসেবে দেওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক আছে।
আমাদের ও আমাদের আশেপাশের দেশগুলোয় ইতিমধ্যে মুখে খাওয়ার অধিকাংশ ( অনেক ক্ষেত্রে এক-দুটি বাদে প্রায় সব) অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনও কাজ করছে না। এই অবস্থা চলমান থাকলে সার্ক জোটভুক্ত চারটি দেশ (নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত) সর্ব-ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড রোগের উৎপাদন ভূমিতে পরিণত হবে।
টাইফয়েড প্রতিরোধে কার্যকর ভ্যাকসিন আছে। জাতীয়ভাবে এই ভ্যাকসিন তরুণ জনগোষ্ঠীকে দেওয়ার বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। টাইফয়েড রোগ নির্ণয়, অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচন, চিকিৎসা গ্রহণের সময়কাল ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি। চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ব্যতিরেকে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয়কে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে।
টাইফয়েডের এই বিপদজনক উত্থানকে জাতীয় নজরদারির আওতায় আনা দরকার। সার্কভুক্ত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। না হয় এ অঞ্চলকে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা অথবা বিধিনিষেধের মুখোমুখি হতে হবে। বহু-ওষুধ প্রতিরোধী, সর্ব-ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ব্যর্থ হলে একটি বৈশ্বিক মানবিক দুর্যোগের প্রেক্ষাপট তৈরি হবে।
ডা. লেলিন চৌধুরী ।। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: