এক বছরেও জুলাই শহীদের স্বীকৃতি মেলেনি শিশু সাব্বিরের, পায়নি সহায়তাও
প্রকাশিত:
১৮ আগস্ট ২০২৫ ১৬:৩১
আপডেট:
১৮ আগস্ট ২০২৫ ২০:২৯

সাব্বির হোসেন। যে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য শিশু বয়সেই নেমে পড়ে রোজগারে। মাত্র ১১ বছর বয়সে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ফ্ল্যাক্সে করে চা বিক্রি করতো সে। অসুস্থ বাবার পাশাপাশি ধরেছিল সংসারের হাল। কিন্তু জুলাইয়ের আন্দোলনে সেই সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা-বাবা। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে এখনো অপেক্ষায় সাব্বিরের মা।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল রাজধানীসহ সারাদেশ। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে কেঁপে ওঠছে চারপাশ। এমন পরিস্থিতিতে বাবা-মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে কেটলি হাতে বেরিয়ে পড়ে ছোট্ট সাব্বির। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ধানমন্ডি এলাকায়।
আবাহনী মাঠের পাশের সড়কে যেতেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যায় সাব্বিরের ওইটুকুন বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা গুরুতর আহতাবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সাব্বিরের বাবা নূর আলম আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি রিকশাচালক। ছোট ছোট তিনটি সন্তান নিয়ে রায়েরবাজার আজিজ খান রোডে একটি টিনশেড বাসায় ভাড়া থাকি। ছেলে মারা গেছে এক বছরের বেশি হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত কেউ এসে খোঁজখবর নেয়নি। শহীদ হিসেবে ছেলের নাম ওঠেনি জুলাই ফাউন্ডেশনে। তাদের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তাও পায়নি। শহীদ হিসেবে আমার ছেলের স্বীকৃতি মেলেনি এখনো। মাঝে জামায়াতে ইসলাম ও স্থানীয় কয়েকজন লোক এসে কিছু অর্থ সহায়তা দিয়ে গেছে।’
তিনি জানান, একসময় আমি পরিবার নিয়ে বরিশালের নাজিরপুর উপজেলার আমতলায় বসবাস করতাম। আর্থিক টানাপোড়েনে ঢাকায় চলে আসি। মোহাম্মদপুর রায়েরবাজারের আজিজ খান রোডে ছোট একটি টিনশেড বাসায় থাকতে শুরু করি। রিকশা চালিয়ে অল্প কিছু আয় হয়। তাতে সংসার চলে না। তাই বড় ছেলে সাব্বিরকে চায়ের ফ্ল্যাক্স কিনে দিয়েছিলাম। সে হেঁটে হেঁটে চা বিক্রি করতো।
নূর আলম বলেন, প্রতিদিনের মতো গত বছরের ২০ জুলাই সাব্বির চা বিক্রি করতে যায়। সেদিন ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের কাছে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। সেসময় একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। সাব্বির সেটা দেখতে যায়। তখনই পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে আমার ছেলের পুরো শরীর ঝাঝরা করে দেয়। ও মাটিতে পড়ে গেলে কয়েকজন ছাত্র শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার জানায়, সাব্বির আর নেই।
তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডি এলাকায় প্রচন্ড গোলাগুলি হচ্ছে- এ খবর শুনে আমি এবং আমার স্ত্রী ছেলেকে খুঁজতে বের হই। কিন্তু কোথায়ও পাই না। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে স্যারদের অনেক রিকোয়েস্ট করে সিসিটিভি ফুটেজে আমার ছেলের লাশ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। দেখি অনেক মানুষের লাশের মধ্যে আমার ছেলেও পড়ে আছে।’
ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সাব্বিরের মা মাকসুদা বেগম। সাব্বিরের নাম ধরে আহাজারি করতে করতেই বেলা কাটে তার।
তিনি বলেন, ‘ওইদিন বহু কষ্টে আমার প্রিয় সন্তান সাব্বিরের লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গিয়ে দাফন করি। আমার ছেলের জানাজা দেওয়ার সময় কেউ ভয়ে আসতে চায়নি। কারণ, তখন উপর দিয়ে হেলিকপ্টার ঘুরে ঘুরে মানুষের জটলা দেখলেই গুলি করছিল। কিছুক্ষণ পর পর গুলির শব্দে সবাই আতঙ্কে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে চলে যেত। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আমার বুকের ধন কিভাবে কবরে শুয়ে আছে। সে গুলির শব্দ শুনলেই কেঁপে উঠতো। সেই ছেলে আমার একা একা কবরে শুয়ে আছে।’
মাকসুদা বেগম জানান, ‘আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে তামিম নামে একজন একদিন এসে আমাকে স্বান্তনা দিয়ে যায়। এরপর আমরা বহুবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা এ মাসে হয়ে যাবে, আপনার ছেলের নাম শহীদের খাতায় উঠবে, আপনি সহায়তা পাবেন- এমন নানা কথা বলে মাসের পর মাস ঘোরাচ্ছে।’
এ বিষয়ে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কামাল আকবর জানান, ‘এখনো শহীদ হিসেবে যাদের নাম গেজেটভুক্ত হয়নি, তাদের বিষয়ে খুব শিগগিরই মিটিংয়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেব। তবে এমআইএস স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাতে। তারা এ কাজ সম্পন্ন করে দিলে আমরা শিগগিরই শহীদদের সব ব্যবস্থা করে দিতে পারব।’
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: