বৃহঃস্পতিবার, ৫ই জুন ২০২৫, ২২শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


ওয়াসিম আকরাম: জীবন যাকে নিয়ে খেলেছে


প্রকাশিত:
৩ জুন ২০২৫ ১৬:৩৪

আপডেট:
৫ জুন ২০২৫ ১৪:৪৩

ছবি সংগৃহীত

ততদিনে ক্রিকেট বল হাতে তুলে নিয়েছেন ওয়াসিম আকরাম। টেবিল টেনিস খেলার স্বপ্নটা জলাঞ্জলি দিয়ে বসেছেন। ক্রিকেটে এদিক-সেদিক খ্যাপ খেলে যখন কিছুটা নাম কামিয়েছেন, তখন হুট করেই আসল আরও বড় সুযোগ। বন্ধু খালিদ মাহমুদ খেলতেন কাস্টমস দলে, একদিন আকরামকে জোর করে সাইকেলে চাপিয়ে বসলেন, ‘তুমি তো ভালো খেলছ, প্রতিভা আছে। খ্যাপ খেলা ছাড়ো। ক্রিকেট বলে আসল জায়গায় খেলব চলো।’

আঙুলের কড়ে হিসেব কষলেন আকরাম। দুএকদিন লম্বা সময় সাইকেলে চেপে গেলেন লাহোরের লুধিয়ানা জিমখানা ক্লাবে। অনুশীলন করলেন, বোলিং করলেন। নজরেও আসলেন। কিন্তু কিছু টাকা যা রোজগার হতো সেটা বন্ধ হলো। উল্টো যোগ হলো ভালো খাওয়া, নিয়ম মানা আর ক্রিকেটের বল-ব্যাট কেনার হ্যাঁপা! পাঞ্জাবি ওই তরুণের ওসব সইল না। আকরাম বাবার দারস্ত হলেন, সুখকর কিছু সেখানেও মিলল না। তবে ক্লাব কোচ ঠিকই হিরে চিনল। তাগাদা দিল, সেই তাগাদায় একসময় ক্রিকেটটাকে সিরিয়াসলি নিলেন আকরাম। ওই শুরু, এখনও চলছে—ক্রিকেটই তাকে চিনিয়েছে, দুহাত ভরে দিয়েছে। বলা চলে, ক্রিকেট তাকে টিকিয়ে রেখেছে। নয়তো পাকিস্তানের হাজারো নাম না জানা পুরুষের একজন হতেন ওয়াসিম আকরাম!

লুধিয়ানা জিমখানা ক্লাবের কোচ সিদ্দিক খান ও সৌদ খানের পছন্দ হলো আকরামকে। ছিপছিপে গঠন, দারুণ বোলিং দক্ষতা আর গতি সব মিলিয়ে বোলিংয়ে দারুণ কিছুর সম্ভাবনা জাগালেন আকরাম। খেললেনও তেমন। কোচ খুশি হয়ে আকরাম একটি বল উপহার দিলেন। আকরাম এরপর ব্যাটিং করাই ছেড়ে দিলেন। অনুশীলনে বোলিং করতেন, বাড়িতেও বোলিং করতেন, ম্যাচেও চাইতেন পূর্ণ ওভার। ছোট পরিসরে বড় স্বপ্ন দেখতে থাকা আকরামের পরিধিও বেড়ে গেল। কিন্তু বাগড়া এখানেও।

মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে বাবা চৌধুরী মোহাম্মদ আকরামের দরবারে ডাক পড়ল, ‘খেলে কাটালে হবে না, কিছু পড়াশোনাও তো করতে হবে।’ ক্রিকেট যাকে আষ্টেপিষ্ঠে ধরেছে তাকে দিয়ে কি আর পড়াশোনা হয়। আকরামের হলো না। তবে মাধ্যমিকে ফেল করে বসেননি। উতরে গেলেন। পরিবারের চাপ আসল, ‘উচ্চশিক্ষাও নিতে হবে।’ ছুট লাগালেন কোচ সিদ্দিক খানের কাছে। পরামর্শ চাইলেন। জানালেন, ‘গভর্নমেন্ট কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজ দুটোতেই ক্রিকেট ট্রায়ালে টিকে গেছি।’ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পরে আকরাম বলেছিলেন সেদিনের কথা, ‘কোচ আমাকে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হতে বলেন। ওখানের ক্রিকেট টিমটা ভালো। আমি কলেজে ভর্তি হই।’ কিন্তু যে খেলার জন্য এখানে আসা সেটিই হচ্ছিল না। আকরাম বলেন, ‘এই কলেজের অধিনায়ক ছিলেন বাঁহাতি পেসার। ওনার কারণে আমার একাদশে জায়গা হয়নি। আমি ছিলাম দ্বাদশ ব্যক্তি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে উঠে আমি কলেজ টিমে খেলিনি। তখন আমি পাকিস্তানের জাতীয় দলে খেলি।’

আকরামকে বলা হয়, ‘সুইং অব সুলতান’। কেউ কেউ বলেন, ‘ক্রিকেট বল নাকি আকরামের কথা শুনত। তিনি যেভাবে চাইতেন বল সেভাবেই নাকি ব্যাটারের সামনে পড়ত।’ শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, রিকি পন্টিংদের যুগে তিনি রাজত্ব করেছেন বোলিংয়ে।
কলেজে পা রেখে ধুপ করেই পরিবর্তন হয়ে যায় আকরামের জীবন। ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ডাক পান সাবেক পেসবোলার খান মোহাম্মদের ক্যাম্পে। লাহোরে ক্যাম্প করেন। পরের ধাপ করাচিতে। কিন্তু বোলিংয়ে নতুন বল পাচ্ছিলেন না আকরাম। কোচ সিদ্দিককে দিয়ে অনুরোধ করালেন আগা সাদাত আলীকে। বল পেলেন, নতুন বলে তাণ্ডব চালালেন আকরাম। ততদিনে সম্ভাবনা জোরাল হলো। ওই মাসেই করাচিতে পরবর্তী ধাপের অনুশীলন। সেখানেও গতি আর বোলিংয়ের স্কিল দেখালেন আকরাম। বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন তখনকার প্রধান নির্বাচক সাহিব আহসান। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল। আকরাম ডাক পেলেন জাতীয় দলে, এরপর অভিষেকও হয়ে গেল।

কখনও যিনি প্রথম শ্রেনির ক্রিকেট খেলেননি, কলেজের একাদশেও যার জায়গা হচ্ছিল না তিনিই ঢুকে গেলেন জাতীয় দলের একাদশে। মাত্র এক সেশন নেটে বোলিং করে সরাসরি পাকিস্তান দলে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনদিনের সেই প্রস্তুতি ম্যাচে থাকার ঘটনাটি সবচেয়ে সুখের মনে করেন আকরাম। সেদিনের দলে থাকা তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না, ‘জাভেদ মিয়াঁদাদ আমাকে বললেন, তুমি খেলছ। রাওয়ালপিন্ডির সেই ম্যাচে নাকাশ তাহিরের পরিবর্তে দলে নেয়া হয়। ১৮ বছর বয়সী কারো জন্য সেই শুরুটা ছিল বিশেষ কিছু। প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট পাই। পরেরটিতে দুটি।’ ওই বছরের নভেম্বরে ফয়সালাবাদে জাতীয় দলে ওয়ানডেতে অভিষেক হয়ে যায় আকরামের। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে সেই কিউইদের বিপক্ষেই টেস্টে অভিষেক। এরপর রাজত্ব করেছেন ক্রিকেট।

কিংবদন্তি এই পেসারের আজ ৫৯তম জন্মদিন— সংগৃহীত ছবি
আকরামকে বলা হয়, ‘সুইং অব সুলতান’। কেউ কেউ বলেন, ‘ক্রিকেট বল নাকি আকরামের কথা শুনত। তিনি যেভাবে চাইতেন বল সেভাবেই নাকি ব্যাটারের সামনে পড়ত।’ শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, রিকি পন্টিংদের যুগে তিনি রাজত্ব করেছেন বোলিংয়ে। বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাটাররা তার ভয়ে কাপত। দুইদিকে সুইং করানো, বাতাসে সুইং করানো ক্ষমতা তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলছিল। খেলোয়াড়ি জীবনে একটা বিশেষণও জুটে গেল, ‘দ্য আর্ট অব ফাস্ট বোলিং।’ ১৯৮৪ থেকে ২০০৩—ক্রিকেটকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন বোলিং দিয়ে। পাকিস্তানকে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জেতানোর নায়কও ছিলেন। সেরা পেসার কিংবা সর্বকালের সেরা বাহাতি পেসারের নাম নিলে তার নামই উঠবে সবার আগে। তর্কাতিতভাবে অনেকে তাকে সর্বকালের সেরাও মেনে বসেছেন। কিন্তু ক্রিকেট যার প্রতি এত সদয় ছিল, তিনি যেন কখনও জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হননি। হলে হয়ত তার নামের পাশে আরও কয়েকশ উইকেট থাকত, আরও অনেক কিছু এনে দিতে পারতেন পাকিস্তানকে।

আকরাম তার আত্মজীবনী ‘সুলতান: আ মেমোয়র’ বইয়ে সেসব কথা লিখেছেন। নেশায় বুদ হয়ে পড়েছিলেন, কোকেন নিতেন নিয়মিত। সংসার-সন্তানদের সব সময় দূরে রাখতেন। থ্রোয়িং বিতর্ক, বল টেম্বারিংয়ের কাণ্ডও ঘটিয়েছিলেন। ম্যাচ ফিক্সিংয়েও নাম জড়িয়েছিল তার। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ আসেনি বলে দুবার বেঁচে যান। খেলোয়াড়ি জীবনে একসময়ের বন্ধু ওয়াকার ইউনিসের সঙ্গে তার খারাপ সম্পর্ক নিয়েও কত আলোচনা। জানা যায়, একবার নাকি ওয়াকারের উপর এত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে ড্রেসিংরুম থেকে তাকে বের করে দেন তখনকার কোচ ও অধিনায়ক। ওই ঘটনায় শাস্তিও শোনেন। চোটও দেন বড়সড় বাগড়া। ক্যারিয়ারে নানা সময় ইনজুরি তাকে ভোগান। বোলিংয়ে উড়তে থাকা ক্রিকেটার পাকিস্তানের নেতৃত্বে সফল থাকলেও পরে জড়ান সমালোচনায়। সবশেষ ক্রিকেট ছেড়ে কোচিংয়ে জড়িয়েও হন আলোচিত-সমালোচিত। এখনও সেই ধারা চলছে।

বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট্ট ওয়াসিম আকরাম— সংগৃহীত ছবি
তবে মাঝের সময়টিতে সব হারিয়ে বসতে চলেছিলেন আকরাম। জীবন তাকে নিয়ে রীতিমতো খেলেছিল। নম্বইয়ের দশকে পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের মনস্তাত্ত্বিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করা হুমা মুফতির সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেন ওয়াসিম। ১৯৯৫ সালে বিয়ে করেন দুজন। চড়াই-উৎরাইয়ের বৈবাহিক জীবনে ২০০৯ সালে হুমা মারা যান। দুটি সন্তানও আছে তাদের। আকরামের পতনের শুরু অবশ্য তারও কয়েক বছর আগে। নিয়মিত ২ গ্রাম করে কোকেন নিতেন। স্ত্রী সন্তান থেকে দূরে থাকতেন। পার্টি করে বেড়াতেন। নেশার মাত্রা যখন বাড়ল তখন মাদকাসক্তি নিরাময়েও গেলেন। কাড়িকাড়ি টাকা ঢাললেন আখেরে কিছুই হলো না। স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত পার্টি করতেন আকরাম, কোকেন সেবন করতেন। স্ত্রীও একসময় তাকে ফাঁকি দেন। অনেক অর্থ খসে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আকরাম। নেশার প্রতি আরও ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু হুট করেই সব ছেড়ে দেন। প্রেমে পড়েন তার চেয়ে ১৭ বছরের ছোট এক তরুণীর। শানাইরা থম্পসন নামের সেই নারীর সঙ্গেই জীবন কাটাচ্ছেন আকরাম।

আত্মজীবনীতে আকরাম আত্মলব্ধির কথা বলেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় খ্যাতির সংস্কৃতি একধরনের নেশা। এটি প্রলোভন দেখাবে আর ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেবে। এক রাতে দশটা পার্টিতেও যাওয়া যায়, কেউ কেউ সেটাই করে। এই জীবনযাত্রা আমাকেও ক্লান্ত করে তুলেছিল। আমার সহজ অভ্যাসগুলো ক্রমে বদভ্যাসে পরিণত হলো। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, আমি কোকেনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম।’ অন্ধকার সেই জীবন পেছনে ফেলে আবারও ক্রিকেটে ফিরেছেন আকরাম।

আজ কিংবদন্তি এই ক্রিকেটারের জন্মদিন। ৫৯ বছরে পা রাখা আকরাম একবার বলেছিলেন, ‘জীবনে অনেক ভুল করেছি। চড়াই-উৎরাইয়ের জীবনে ক্রিকেট আমাকে অনেক দিয়েছে। এখনও টিকিয়ে রেখেছে।’ লাহোরের সেই তরুণ এখন বৃদ্ধ হওয়ার পথে। ক্রিকেটের সঙ্গেই আছেন। পাকিস্তানের একজন টেবিল টেনিস প্লেয়ার হতে চাওয়া আকরাম এখনও বিশ্বের সেরা বাহাতি পেসার। একজীবনে ওসব ছোটবড় ভুল না করলে কি ভালো হতো না ওয়াসিম আকরাম?


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top